-- বিজ্ঞাপন ---

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কি বিশ্বের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করবে?

সিরাজুর রহমান#

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে আমরা এমন এক প্রযুক্তির মুখোমুখি হয়েছি, যার প্রভাব ইতোমধ্যেই বিশ্বজুড়ে লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে। আর সেই প্রযুক্তি হচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)। এটি এখন আর শুধু কোনো প্রযুক্তির নাম নয়, বরং এটি এখন এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের হাতিয়ার, যা শিল্প, স্বাস্থ্য, প্রতিরক্ষা, শিক্ষা এবং গবেষণাসহ প্রায় সব খাতে নতুন মাত্রা যোগ করছে। একে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে নতুন সম্ভাবনার পাশাপাশি কিছু শঙ্কাও।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এই প্রযুক্তিকে দ্রুত গ্রহণ করে নিজেদের কর্মদক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ভারতসহ অনেক দেশ ইতোমধ্যে AI নির্ভর স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি ও রোবটিক্সের বাস্তব প্রয়োগ শুরু করেছে। উদাহরণস্বরূপ, অস্ত্রোপচারে সহায়ক রোবট, বায়োনিক অঙ্গ, হাসপাতালের পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতায় স্বয়ংক্রিয় রোবট, সীমান্ত নিরাপত্তায় অটোনোমাস ড্রোন এবং ওষুধ সরবরাহে রোবটিক ডেলিভারি সিস্টেম সফলভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও এই প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। যেমন- কমব্যাট ড্রোন, স্মার্ট মিসাইল ও উন্নত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম দ্বারা বর্তমানে প্রচলিত যুদ্ধের ধারণা ও কৌশল দ্রুত বদলে যাচ্ছে। বিশেষ করে ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ এবং ভারত পাকিস্তানের মধ্যে চলা সীমিত যুদ্ধে সারা বিশ্ব এক ভিন্ন মাত্রার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা অটোনোমাস কমব্যাট ড্রোনের ব্যাপক ও কার্যকর ব্যবহার প্রত্যক্ষ করল।
তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে AI–কে এখনো অনেকাংশে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। অনেকেই মনে করে, AI মানেই ছবি বা ভিডিও এডিট করা, গল্প লেখা বা কণ্ঠ নকল করে ভিডিও তৈরি করা। অথচ বাস্তবে AI–এর ব্যবহার এর চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত ও গভীর। এটি চিকিৎসা, কৃষি, মহাকাশ গবেষণা এমনকি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
AI–কে শুধুমাত্র টুল হিসেবে নয়, বরং একটি বৈশ্বিক পরিবর্তনের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে আমরা আরেকটি শিল্প–বিপ্লবে পিছিয়ে পড়ব। যেমনটা ব্রিটিশ আমলে ইংরেজি শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ায় আমাদের সমাজ প্রযুক্তি ও প্রশাসনের মূলস্রোত থেকে অনেকটাই দূরে সরে গিয়েছিল।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ‘Future of Jobs Report 2023’ অনুযায়ী, AI ও অটোমেশনের কারণে আগামী পাঁচ বছরে প্রায় ১৪ মিলিয়ন কর্মসংস্থান বিলুপ্ত হতে পারে। এ তথ্য থেকে বোঝা যায়, AI যেমন নতুন চাকরির ক্ষেত্র সৃষ্টি করছে, তেমনি প্রচলিত অনেক পেশাকে হুমকির মুখে ফেলছে। তাই সময় থাকতেই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা দরকার।
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোতে AI ও রোবটিক্স–নির্ভর গবেষণা বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের শুধু ব্যবহারকারী নয়, বরং উদ্ভাবক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে শিল্পখাতের বাস্তব সংযোগ গড়ে তুলতে পারলে তরুণরা পড়াশোনার পরপরই দক্ষ কর্মী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে পারবে।
সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো যে, আমাদের অবশ্যই প্রযুক্তিতে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে হবে। আমরা যদি শুধু বিদেশি প্রযুক্তির উপর নির্ভর করি, তাহলে আমাদের অবস্থান সবসময়ই দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় সারিতে পরে থাকবে। তাই অদূর ভবিষ্যতে আমাদের নিজস্ব প্রযুক্তি উন্নয়ন, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি এবং গবেষণায় বিনিয়োগ ছাড়া টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। তাই আমাদের মেধাবী তরুণ সমাজ, পর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং সময়োপযোগী নীতিনির্ধারণের সমন্বয়েই আমাদের AI বিপ্লবের অংশীদার হতে হবে।
সবশেষে বলা যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন কল্পনা নয়, বাস্তবতা। এটি গ্রহণ না করলে আমরা পিছিয়ে যাবো, কিন্তু সময়মতো এর সঠিক ও কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে আমরাও আগামী পৃথিবীর প্রযুক্তি–নির্ভর উন্নয়নের শরিক হতে পারব। তাই এখনই সময়, এই অভাবনীয় প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেদের মেধা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করা।
তাই পরিশেষে বলা যায় যে, স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমরা এখনও প্রযুক্তিগতভাবে অন্য দেশের উপর অতিনির্ভরশীল। প্রযুক্তি আমদানি করে সাময়িক সমাধান করা গেলেও টেকসই সমাধান হবে নিজস্ব দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির লক্ষ্যে নতুন নতুন প্রযুক্তি নির্ভর গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। এজন্য চীন এবং আমেরিকার মতো না হলেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নিবিড় গবেরষণায় (R&D) খাতে স্বল্প পরিসরে হলেও পরিকল্পিতভাবে বিনিয়োগ ও বাজেট বরাদ্দ রাখতে হবে।

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.