-- বিজ্ঞাপন ---

চীনে ৩.৬৮ মিলিয়ন টন থোরিয়াম আবিষ্কার

সিরাজুর রহমান#

বিশ্বজুড়ে যখন নবায়নযোগ্য জ্বালানির সন্ধান চলছে এবং কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের চাপে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার প্রয়াস চলছে, তখন থোরিয়াম (Thorium) উঠে আসছে একটি সম্ভাবনাময় ও টেকসই পারমাণবিক জ্বালানি হিসেবে। এটি ইউরেনিয়ামের চেয়ে নিরাপদ, অধিক পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম, এবং পারমাণবিক বর্জ্য অনেক কম সৃষ্টি করে।

চীনের সিচুয়ান প্রদেশে সম্প্রতি প্রায় ৩.৬৮ মিলিয়ন টন প্রাকৃতিক থোরিয়াম (Th-232) এর মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। গবেষকদের দাবি অনুযায়ী, এই পরিমাণ রেডিও অ্যাক্টিভ থোরিয়াম চীনের বিদ্যুতের চাহিদা আগামী প্রায় ৬০ হাজার বছর পর্যন্ত মেটাতে সক্ষম হবে। যদিও এটি একটি প্রাথমিক অনুমান, তবুও এই আবিষ্কার থোরিয়াম-ভিত্তিক জ্বালানির সম্ভাবনাকে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছে। আর নতুন এই আবিষ্কার চীনের পূর্বঘোষিত আনুমানিক ১ মিলিয়ন টনের প্রমাণিত রিজার্ভকে কয়েকগুণ ছাড়িয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

থোরিয়াম (Thorium, সংকেত: Th) একটি প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত রেডিও অ্যাক্টিভ মৌল, যা ইউরেনিয়ামের বিকল্প হিসেবে পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদনে ব্যবহৃত হতে পারে। এটি Th-232 আইসোটোপ হিসেবে প্রকৃতিতে পাওয়া যায়, যা নিউট্রন শোষণ করে ইউরেনিয়াম-২৩৩ এ রূপান্তরিত করা যেতে পারে। থোরিয়ামের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর স্বতঃনিয়ন্ত্রিত এবং ঝুঁকিমুক্ত শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়া। মূলত মোল্টেন সল্ট রিঅ্যাক্টরে (MSR) Th-232 নিউট্রন শোষণ করে ইউরেনিয়াম-233-এ রূপান্তরিত হয়, যা প্রচলিত ইউরেনিয়াম চুল্লির তুলনায় ৯০% কম দীর্ঘস্থায়ী তেজস্ক্রিয় বর্জ্য তৈরি করে।

ভারতের কেরালা রাজ্যে বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রমাণিত ৮.৪৬ লক্ষ টন থোরিয়াম মজুদ রয়েছে। যার ফলে ভারতকে বিশ্বের মধ্যে থোরিয়াম সুপার পাওয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাছাড়া ব্রাজিল (৬.৩ লক্ষ টন), অস্ট্রেলিয়া (৫.৯ লক্ষ টন) এবং যুক্তরাষ্ট্র (৪০ হাজার টন) আনুমানিক থোরিয়াম মজুত থাকতে পারে। তবে চীনের এই নতুন আবিষ্কৃত প্রায় ৩.৬৮ মিলিয়ন টন থোরিয়ামের মজুত বৈশ্বিক পর্যায়ে দেশটির অবস্থানকে হয়ত আরো শক্তিশালী করবে। বর্তমানে রেডিও অ্যাক্টিভ থোরিয়াম ভিত্তিক নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত জ্বালানি গবেষণায় বৈশ্বিক পর্যায়ে নেতৃত্বের আসনে রয়েছে রেড জায়ান্ট চীন।

চীন এখন লিকুইড ফ্লোরাইড থোরিয়াম রিঅ্যাক্টর (LFTR) প্রযুক্তির উন্নয়নে এখন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। গত ২০২১ সালে গোবি মরুভূমিতে একটি পরীক্ষামূলক উচ্চ প্রযুক্তির Molten Salt Reactor (MSR) সিস্টেম চালু করে। যা self-regulating system হিসেবে কাজ করে এবং core meltdown বা নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণের ঝুঁকি কম বলে দাবি করা হয়।

বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেছেন যে, রেডিও অ্যাক্টিভ থোরিয়াম উপাদান থেকে সরাসরি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা যায় না, তাই এটিকে ‘নন-প্রোলিফারেশন’ জ্বালানি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর পাশাপাশি প্রকৃতিতে এই তেজষ্ক্রিয় উপাদান বিপুল পরিমাণে মজুত রয়েছে। বর্তমানে থোরিয়ামের বাণিজ্যিক ব্যবহার একেবারেই সীমিত হলেও গবেষণার জন্য উচ্চ শুদ্ধতার রেডিও অ্যাক্টিভ থোরিয়াম অক্সাইড (ThO₂) আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি আনুমানিক ৩,০০০ থেকে ১০,০০০ ডলারে বিক্রি হতে পারে। যদিও এই প্রযুক্তি এখনও পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে, তবে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে আগামী ২০৬০ সালের মধ্যে থোরিয়াম ভিত্তিক নিরাপদ শক্তি উৎপাদন বাণিজ্যিকভাবে চালু হতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

পরিশেষে বলা যায় যে, থোরিয়াম ভিত্তিক জ্বালানি ব্যবস্থা এখন কেবল আর গবেষণার বিষয় নয়, এটি ভবিষ্যতের ক্লিন এনার্জি-এর একটি শক্তিশালী এবং সম্ভাবনাময় বিকল্প হিসেবে দেখা হচ্ছে। যা অদূর ভবিষ্যতে হয়ত সারা বিশ্বে নিরাপদ জ্বালানি ব্যবস্থার এক নতুন বিপ্লব সূচনা করতে পারে।

তথ্যসূত্র (নির্ভরযোগ্য):
1. South China Morning Post, April 2024: “China discovers 3.68 million tonnes of thorium in Sichuan province.”
2. World Nuclear Association (WNA), May 2024: Overview on thorium resources.
3. USGS Mineral Commodity Summaries: Historical thorium reserve data.

 

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.