সিরাজুর রহমান#
“হাবল স্পেস টেলিস্কোপ ১৯৯০ সালে মহাকাশে যাত্রা শুরু করে, আজও মহাবিশ্বের গভীরতম রহস্য উন্মোচনে কাজ করে যাচ্ছে।” নাসার হাবল স্পেস টেলিস্কোপ হলো পৃথিবীর বাইরে মহাকাশে স্থাপিত প্রথম শক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্র, যা ১৯৯০ সালের ২৪ এপ্রিল স্পেস শাটল ডিসকভারি (STS-31) মিশনের মাধ্যমে NASA উৎক্ষেপণ করে। বর্তমানে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা NASA এবং ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা ESA-এর যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হচ্ছে। মহাকাশ অনুসন্ধান ও গবেষণায় NASA-এর উচ্চাভিলাষী এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রজেক্ট হিসেবে হাবল স্পেস টেলিস্কোপ তৈরির অনুমোদন দেওয়া হয় ১৯৭৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে। পরবর্তীতে NASA-র তত্ত্বাবধানে এটি ডিজাইন ও তৈরি করা হয়। মূলত বিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন পাওয়েল হাবলের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় হাবল স্পেস টেলিস্কোপ (HST)। তবে উৎক্ষেপণের পর হাবলকে প্রথমে পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫৯৬ কিলোমিটার উচ্চতায় নিম্ন কক্ষপথে স্থাপন করা হয়। সময়ের সঙ্গে অরবিট পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে এটি পৃথিবী থেকে প্রায় ৫৪০ কিলোমিটার উচ্চতায় অবস্থান করছে এবং প্রতি ৯৭ মিনিটে একবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। এটি এখনো পর্যন্ত মহাবিশ্বের দূরবর্তী অঞ্চলের প্রায় কয়েক মিলিয়ন ছবি ও বিপুল বৈজ্ঞানিক ডেটা পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। হাবল স্পেস টেলিস্কোপ তৈরিতে এর প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয় প্রায় ২-২.৫ বিলিয়ন ডলার। তবে পরবর্তীতে সার্ভিসিং মিশন, মেরামত, ক্যামেরা আপগ্রেড এবং দীর্ঘমেয়াদি অপারেশন মিলিয়ে এই প্রকল্পের মোট ব্যয় বর্তমানে প্রায় ১৫-১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছে NASA। যদিও এই ব্যয়ের চূড়ান্ত হিসাব বাস্তবে কিছুটা কম বা বেশি হতে পারে। তবে গত ১৯৯০ সালে হাবল স্পেস টেলিস্কোপ কক্ষপথে স্থাপন করা হলেও প্রাথমিকভাবে হাবলের প্রধান লেন্সের কিছু সূক্ষ্ম ত্রুটি থাকার কারণে ছবিগুলো অনেকটাই ঝাপসা ও অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। এই সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯৯৩ সালে NASA একটি বিশেষ স্পেস শাটল মিশনের মাধ্যমে Correction Optics এবং নতুন একটি WFPC2 ক্যামেরা স্থাপন করে। এরপর ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বর মাস থেকেই হাবল হাজার হাজার আলোকবর্ষ দূরের অত্যন্ত স্পষ্ট, নিখুঁত ও চমকপ্রদ ছবি পাঠাতে শুরু করে। হাবল স্পেস টেলিস্কোপের Deep Field এবং Ultra Deep Field ইমেজগুলো মহাবিশ্বের অত্যন্ত দূরবর্তী গ্যালাক্সির ছবি ধারণে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি ডার্ক এনার্জির অস্তিত্ব প্রমাণ, এক্সোপ্ল্যানেটের বায়ুমণ্ডল অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ, তারার জন্ম-মৃত্যু, সুপারনোভা বিস্ফোরণ এবং ব্ল্যাক হোলের নিকটবর্তী অঞ্চলের আচরণ জানতে হাবল এখনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। গত ২০২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর উৎক্ষেপিত নাসার নতুন প্রজন্মের James Webb Space Telescope (JWST) বর্তমানে হাবলের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। যেখানে হাবল অপটিক্যাল ও অতিবেগুনি আলোতে কাজ করে, সেখানে জেমস ওয়েব ইনফ্রারেড তরঙ্গে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম। ফলে এই দুই টেলিস্কোপের সমন্বিত ও ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণ আজ মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের আরও বিস্তৃত তথ্য ও নিখুঁত ইমেজ প্রদান করছে। আকারের দিক বিবেচনায় হাবল স্পেস টেলিস্কোপ হয়ত একটি স্কুল বাসের সমান হতে পারে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৩.২ মিটার এবং ব্যাস ৪.২ মিটার এবং ওজন প্রায় ১১.১১ টন। বর্তমানে এর কার্যক্ষম লাইফ সাইকেল বা সময়সীমা ২০৩০ সাল পর্যন্ত ধরা হলেও ধারাবাহিক সফটওয়্যার আপডেট এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতা আপগ্রেডিং এর মাধ্যমে হয়ত আগামী ২০৪০ সাল পর্যন্ত কার্যকর রাখা সম্ভব হবে বলে প্রত্যাশা করে NASA। সবশেষে বলা যায়, হাবল স্পেস টেলিস্কোপ মানবজাতির আধুনিক মহাকাশ অনুসন্ধান ও গবেষণার ইতিহাসে এক অনন্য ও অভূতপূর্ব প্রযুক্তিগত অর্জন। এটি শুধু অজানা মহাজাগতিক রহস্য উন্মোচন করছে না, বরং মানবজাতির মহাবিশ্ব-সম্পর্কিত জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে হাবল ও জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের যৌথভাবে মহাকাশ অনুসন্ধান হয়তো আরও বিস্ময়কর মহাজাগতিক বিষয় আমাদের সামনে উন্মোচন করবে।##তথ্যসূত্র: NASA, ESA, DW, Wikipedia, Rora Bangla.

